
কবিতার ইন্দ্রজালে একবার জড়িয়ে গেলে তা থেকে বেরিয়ে আসা যেমন দূরুহ তেমনি অসাধ্যও। কবিতার পাওয়ার, কবিতার স্পিড্ কাব্যপ্রেমিক মাত্রই যাদুকরী এক মায়াময়তার কুহকে সিক্ত করে রাখে অনন্তকাল ধরে।
বৃষ্টির মায়াবি গুঞ্জরণের ছন্দমাতাল এক অতিপ্রাকৃতিক অবগাহন কাব্যরসিকের রন্ধ্রেরন্ধ্রে এক অনাস্বাদিত অনুভূতির অনুরণন সৃষ্টি করে। যে অনুরণন ওঠে বন্দর ছেড়ে যাওয়া জাহাজের প্রপেলারের ঘূর্ণনের তীব্র জলকল্লোলের মতো।
কবিতার এই অন্তহীন হাইওয়েতে যে পা-বাড়ায় তার আর ফেরার পথ থাকে না। কবিতার মায়াচ্ছন্নতা তাকে বন থেকে বনান্তর, মন থেকে মনান্তরের গভীর গহনে গুণিনের মতো টেনে নিয়ে যায়। কবিতার এমনই এক অপরিসীম শক্তি রয়েছে যা চোখে দেখা যায় না। শুধু উপলব্ধি করা যায়।
আর ওই কবিতা যদি হয় প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা। তাহলেতো কথাই নেই। তেমনি এক প্রেম ও প্রকৃতির আপাদমস্তক কবি- নব্বই দশকের শীর্ষসারির প্রাণবন্ত কবি দর্পণ কবীর, যার কবিতার রানওয়েতে দাঁড়িয়ে এক বিকেলের কথার মঞ্জুরি ছড়িয়ে যায় রাঙা মার্বেলের মতো। প্রেমের কবিতায় ফেঁসে গিয়ে কবি দর্পণ কবীর ক্রমাগত কবিতার অরণ্যের গহীনে হারিয়ে যেতে যেতে রচনা করেছেন এমন সব কবিতার শব্দাঞ্জলি। যার রিদম আর সিম্ফনি পাঠকের ইন্দ্রিয়ে জ্যোৎস্নার গুঁড়ো ঝরা নির্জন সন্ধ্যার মতো গেঁথে গিয়ে এক অলৌকিক উৎসারণের দৃশ্যাবলী রচনা করে।
কবি দর্পণ কবীর তিনদশককাল ধরে কবিতার পথে হেঁটে হেঁটে যে কবিতার অজস্র ঝরাপাতা কুড়িয়ে এনে তুলে রেখেছেন তার কবিতারই কুলঙ্গিতে। তারই এক ম্যাচিউর উদ্ভাসন প্রতীয়মান হলো এক জীবন্ত জলরঙে আঁকা কাব্যগ্রন্থ ‘কথোপকথন’-এ এসে।
‘কথোপকথন; কাব্যগ্রন্থটি ২০২৫ এর ফেব্রুয়ারিতে ঝুমঝুমি প্রকাশনী প্রকাশ করে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। কবি দর্পণ কবীর দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার নিউইয়র্বে বসবাস করলেও মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি তার কমিটমেন্ট থেকে একরত্তিও দূরে সরে যাননি। বরং দেশবোধ, প্রেমাত্ববোধের প্রতি তার অবিশ্রাম টান ‘কথোপকথন’ কাব্যগ্রন্থে যেনো আরো বিপুল বৈভব নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রেম যেনো এক অপার্থিব ফর্মেট নিয়ে সকল আচ্ছন্নতাকে উড়িয়ে দিয়ে বুকের গহনে পুঞ্জিভূত হয়েছে এক মহৎ আবেগে। আর এখানেই কবি দর্পণ কবীরের কাব্যশক্তি বাক্সময় রূপে পরিবেশিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রেম কিংবা ভালোবাসায় কবিতায় দর্পণের মিষ্টি পঙ্ক্তি’র গ্রন্থ যা পাঠক মাত্রেই ঝর্ণাজলে ভিজিয়ে তোলে যা দর্পণের কাব্যবোধেরই মনোমুগ্ধকর সহজাত প্রবৃত্তি। ‘কথোপকথন’ কবিতার বই যখোন হাতে আসে- তখোন ৭০ পৃষ্ঠা ব্যাপি গ্রন্থিত ৫৭টি কবিতার প্রাঞ্জল পঙ্ক্তির উজ্জ্বল প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঋজু বিকেলের মতোই নিমজ্জিত থেকে- পরিশেষে স্থির একটা ম্যানারিজমের চক্করে পড়ে গিয়ে কিশোর প্রেমিকের ভালোবাসার ঝড়ো বাতাসের তোড়ে ভেসে যেতেই হলো যেনো। ‘কথোপকথন’-এর কবিতাগুলোই এই ঝোড়ো হাওয়ার তুফানজাগা অন্তরীপে এন ভাসিয়ে দিয়েছে ছই নৌকার মতো। যেনো এক একান্নবর্তী ভোরের মতো উদ্ধেল মনকে একবৃত্তে এনে জাগিয়ে তোলে।
কবি দর্পণ কবীর বরাবরই সিদ্ধহস্ত পেমের কবিতায়। তারই কিছু নিপুণ আর নিখুঁত উদ্ধৃতি তুলে দেয়া হলো। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ‘কথোপকথন’-এর প্রতিটি কবিতারই রয়েছে প্রাক্ শিরোনাম এবং কথ্য প্রেমের বয়ানকে জীবন্ত করে তোলার প্রয়াসে পুরুষ এবং নারী খচিত উপ-শিরোনাম। আর এখনেই দর্পণের কাব্যবোধের মিহিন কারুকার্যকে উৎকীর্ণ করে তোলার সাবলীলতাকে জাগিয়ে দ্যায়।
যেনো বিশ্ববিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান ডেভিড কপার্ড ফিল্ডের যাদুকরীর এক ঐশ^রিক চৈতন্যকে খুঁজে পাওয়া যায়- না ছায়াহারা পাওয়া ছায়ার মতোন।
‘তোমাকে দেবো রোদেলা সকাল, গুমোট দুপুরের উদাসীনতা
হিরন্ময় বিকাল বা চাঁদের আগুনে দগ্ধ নির্বুম রাত।’
(তোমাকে দেবো/কথোপকথন)
‘এসো, ভালোবাসার নাম দিই- ধূসর দিগন্ত,
নিঃসঙ্গতার নাম- কাঁঠাল চাঁপার সৌরভ।
বিরহের নাম হতে পারে দলছুট মেঘের বিলাপ,
চুম্বনের নাম সমর্পন।’
(মতান্তর/কথোপকথন)
‘কিছু গল্প মেঘের দেশে
চরকি কাটে
কিছু গল্প মুঠোবন্ধী
তোমার হাতে।
কিছু গল্প মরুরোদে
জর্জরিত
কিছু গল্প জলে ভিজে
গায় যে গীতও।’
(কিছু গল্প/কথোপকথন)
প্রবাসী কবি দর্পণ কবীরের ‘কথোপকথন’-এর প্রচ্ছদ, অলংকরণ করেছেন মামুন হোসাইন ও সুমন কবিরাজ। মূল্য ৫৪০ টাকা। ‘কথোপকথন’ কবি দর্পণ কবীরের এক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ইতোমধ্যে বেশ প্রসংশা কুড়িয়েছে- যা যথার্থ। ইতোমধ্যে স্বদেশে এবং আমেরিকা, কানাডা, কোলকাতার বাঙালি পাঠক মহলে ‘কথোপকথন’ এক অনস্বীকার্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের ধারায় সাড়া জাগাতেও সমর্থ হয়েছে। এখানেই কবি দর্পণ কবীরের বৈচিত্র্যমণ্ডিত উজ্জ্বল উদ্ভাসন নির্ণিত হয়েছে।