
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ১৬ জুলাইয়ের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে দেশের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে সংস্থাটি বলেছে, এই সহিংসতা শুধু রাজনৈতিক সহনশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে না, বরং নাগরিকদের সভা-সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকারকেও চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।
সরেজমিনে আসকের তদন্ত
২১ ও ২২ জুলাই আসকের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গোপালগঞ্জে গিয়ে নিহত, আহত, আটক ও গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় নাগরিক, পেশাজীবী, কারাগার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। আজ শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো প্রতিবেদনে আসক জানিয়েছে, সহিংসতার সময় ও পরবর্তী পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ঘটনার দিন সকাল থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকেরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন, যাঁদের হাতে লাঠিসোঁটা ও দেশি অস্ত্র ছিল”। সমাবেশ চলাকালে এনসিপির নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর রাস্তায় নামে ‘সাধারণ জনতা’ এবং প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।
নির্বিচার ধরপাকড় ও ভীতিকর পরিস্থিতি
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ জুলাই রাত থেকে কারফিউ ও ১৪৪ ধারা জারি করে ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ও করা হয়েছে। অনেক সাধারণ মানুষ ভয়ে নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি যেসব এলাকায় সহিংসতা হয়নি, সেসব এলাকাতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরপাকড় চলে।
ময়নাতদন্ত নিয়ে হয়রানির অভিযোগ
নিহত পাঁচজনের মধ্যে কেবল ঢাকায় মারা যাওয়া রমজান মুন্সীর ময়নাতদন্ত করা হয়েছে বলে জানায় আসক। বাকি মৃতদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাপ প্রয়োগ করে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে নিহত ইমন তালুকদারের শরীরে গুলির ও আঘাতের চিহ্ন থাকলেও তাঁর ময়নাতদন্ত হয়নি।
পরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর ২০ জুলাই তিনটি মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হয়, যাতে উপস্থিত ছিল আসকের প্রতিনিধিদল। পরিবারগুলো এই প্রক্রিয়াকে “নতুন ধরনের হয়রানি” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
মামলা, গ্রেপ্তার ও শিশুরা
আসকের তথ্যমতে, ২১ জুলাই পর্যন্ত গোপালগঞ্জে আটটি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ছয়টির কপি তাদের হাতে এসেছে। এসব মামলায় মোট ৫ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৫৮ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ৩ জন নারী ও ৩২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এসব মামলায় আসামি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ১৮ জন শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেককেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দেখানো হয়েছে। পরিবারগুলোর দাবি, এসব শিশুরা সংঘর্ষে অংশ নেয়নি।
আহত ও নিহতের তথ্য
গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তথ্যমতে, ১৬ জুলাই সংঘর্ষে ২৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ২১ জন সাধারণ মানুষ, ২ জন পুলিশ সদস্য ও ১ জন ইউএনওর গাড়িচালক।
তবে হাসপাতালের রিপোর্টে গুলিবিদ্ধ কারও অস্তিত্ব স্পষ্ট নয়, যদিও কয়েকজন নিহত ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ ছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।
প্রশাসনের অবস্থান
গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার আসকের প্রতিনিধি দলকে জানান, “পুলিশ কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি বরং সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করেছে।” তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর দুটি এপিসি মোতায়েন করা হয় এবং এনসিপি নেতাদের নিরাপত্তার জন্য তাঁর কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল।
তিনি জানান, ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মামলার সংখ্যা ৮টি। কারাগার ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কিত মামলাগুলো তখনো দায়ের হয়নি।
বাধা ও অসহযোগিতার অভিযোগ
আসকের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি প্রতিনিধিদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও দেখা করতে পারেনি তারা।