১৯৭১ সালে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে, ঢাকার চারপাশে অন্ধকার রাত, আতঙ্কিত মানুষ, পাকিস্তানি সেনার গর্জন এবং শহরের উপত্যকায় ভয়ংকর তল্লাশি—এই দৃশ্যের মাঝেই শুরু হয়েছিল এক বিপ্লব। ঠিক তখনই বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জন্ম নেয় অদম্য সাহস, আর পাশে দাঁড়ায় তাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত।
এটি ছিল এক অসাধারণ যৌথ সংগ্রাম, যার চারটি অবিচ্ছেদ্য স্তম্ভ ছিল—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী ও অবিসংবাদিত নেতৃত্ব, লাখো মুক্তিযোদ্ধার রক্তঝরা আত্মত্যাগ, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অটল রাজনৈতিক সাহস এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশের (যিনি পরে ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল হন এবং গোর্খা সৈন্যদের কাছে চিরকালের ‘স্যাম বাহাদুর’) অসামান্য সামরিক প্রতিভা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই চার শক্তির সম্মিলন ছাড়া ১৬ ডিসেম্বরের সোনালি সূর্যোদয় কখনোই উদিত হতো না। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সোনালি ইতিহাসে চারটি নাম বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই যুদ্ধের আত্মা। ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়—এসবই ছিল স্বাধীনতার দিকে অবধারিত পথচলা। ৭ মার্চের ভাষণে যখন তিনি বললেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”, তখনই বাঙালি জাতি একটি অদৃশ্য শপথ নিয়ে ফেলেছিল। ২৫ মার্চ গ্রেপ্তারের ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন, সেই বেতার বার্তা চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নয় মাস তিনি কারাগারে থাকলেও তাঁর নামই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় মন্ত্র। প্রতিটি ক্যাম্পে তাঁর ছবি, প্রতিটি অপারেশনের আগে তাঁর নামে শপথ—এভাবেই বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত থেকেও সর্বত্র উপস্থিত ছিলেন।
তারপর আসে লাখো মুক্তিযোদ্ধার কথা—যাঁরা মাঠে-ময়দানে যুদ্ধটা করেছেন। ছাত্র, যুবক, কৃষক, শিক্ষক, মেয়েরা, এমনকি কিশোররাও অস্ত্র হাতে নিয়েছে। মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, ক্র্যাক প্লাটুন, নৌ-কমান্ডোরা—সবাই মিলে যে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছে, তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া, সেতু ধ্বংস, অ্যামবুশ, সাপ্লাই লাইন কেটে দেওয়া—এসব ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় সাফল্য অসম্ভব ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাকে ঢাকার দিকে টেনে এনে আটকে রেখেছিল, যাতে ভারতীয় সেনা দ্রুত অগ্রসর হতে পারে।
এই দুই বাংলার মাঝে এসে দাঁড়ান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন, এবং বাংলাদেশিদের প্রতি ভারতের মানবিক সহায়তা—শরণার্থী আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা—ব্যাপক ও নথিবদ্ধ। ভারত সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব নিয়েছিল। পাশাপাশি স্বাধীনতাকামী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ, গেরিলা অপারেশন পরিচালনার সুবিধা তৈরি এবং সীমান্তজুড়ে লজিস্টিক সহায়তা দিয়ে ভারত কার্যকরভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে। এই সহযোগিতার ফলেই পরে যৌথ বাহিনী (Mitro Bahini) গঠিত হয় এবং যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এর প্রভাব ছিল সরাসরি।
আর সেই সেনাবাহিনীর মাথায় ছিলেন জেনারেল স্যাম মানেকশ—যাঁর সামরিক নেতৃত্ব, পরিকল্পনা এবং বাস্তবতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত ১৯৭১-এর যুদ্ধ পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখেছিল। তিনি পূর্ণমাত্রায় অপারেশন শুরুর আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পূর্বাঞ্চলে সংগঠিত করেন, লজিস্টিক প্রস্তুতি নেন এবং তিন বাহিনীর সমন্বয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, যিনি শেষ পর্যন্ত ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেন। মানেকশের নেতৃত্ব ও সমন্বয় যুদ্ধের ফলাফলকে দ্রুত ও নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছিল।
১৬ ডিসেম্বর যখন ঢাকার রেসকোর্সে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের দলিল সই হয়, সেখানে জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিরাও। ইন্দিরা গান্ধী যখন একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন, তখন জেনারেল মানেকশ মেনে নিলেন—কারণ তিনি জানতেন, বিজয়ের পর বিনয়ই সবচেয়ে বড় শক্তি। আর সেই বিজয়ের পেছনে ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত।
আজ যখন দুই দেশের মধ্যে কখনো কখনো মেঘ দেখা যায়, তখন এই চারটি নাম একসঙ্গে স্মরণ করা দরকার—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লাখো মুক্তিযোদ্ধা, ইন্দিরা গান্ধী এবং স্যাম মানেকশ। ১৯৭১-এর বিজয় তাঁদের যৌথ অর্জন, যার প্রতিটি নাম ছাড়া বিজয়ের ছবি অসম্পূর্ণ থাকত।
লেখক - সিনিয়র সাংবাদিক



