০২ জুন ২০২৫ , ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ 

বিদেশ

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের

প্রকাশিত: ০০:০৪, ২৩ মে ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সম্প্রতি বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির মতে, এসব পদক্ষেপ মৌলিক স্বাধীনতাকে খর্ব করার ঝুঁকি তৈরি করছে।

গতকাল বুধবার (২১ মে) প্রকাশিত 'বাংলাদেশ: রিভিউ ল'স অ্যান্ড প্রোটেক্ট হিউম্যান রাইটস স্ট্যান্ডার্ডস' শীর্ষক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক আইনপ্রণয়নের উদ্যোগগুলো মৌলিক স্বাধীনতাকে খর্ব করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি এবং গুরুতর অনিয়মের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরিবর্তে, এই সরকার ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের সমর্থকদের অধিকার দমন করছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি সংশোধনের আওতায় নতুন ক্ষমতা ব্যবহার করে ১২ মে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে 'অস্থায়ী' নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় দলটির সভা-সমাবেশ, প্রকাশনা এবং অনলাইনে তাদের পক্ষে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিগত সরকারের সময়ে ঘটানো জোরপূর্বক গুমের ঘটনা মোকাবিলায় প্রণীত আইনের খসড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করেনি এবং এসব অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেও খুব একটা কার্যকর নয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, 'শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতে বৈধ ক্ষমতা অপব্যবহার করেছে। তবে এখন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বিরুদ্ধেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে, তা একই ধরনের মৌলিক স্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসেবে দেখা যাবে। অন্যদিকে, জোরপূর্বক গুম নিয়ে করা আইনের খসড়া ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করে না, এবং হাসিনার শাসনামলে গুম হওয়া শত শত ভিকটিম ও তাদের পরিবারের জন্যও তেমন কোনো জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে না।'

তিন সপ্তাহের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হওয়ার পর, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা হারায়। এরপর, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের আগে গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা পুনঃস্থাপনের অঙ্গীকার করে অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে আছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

নতুন সরকার ইতোমধ্যে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সম্প্রতি কিছু সিদ্ধান্ত হতাশার কারণ হয়েছে। ১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতারা যেসব অনিয়ম ও অপরাধ করেছেন, সেগুলোর বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটির ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। আর এই বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। ফলে, বাস্তবে দলটিকে নিষিদ্ধ করার মতো পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দলটির সবরকম কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যেকোনো রকম প্রকাশনা, মিডিয়া, অনলাইন ও সামাজিক মিডিয়া, যেকোনো প্রচারণা, র‌্যালি, মিটিং, সমাবেশ, কনফারেন্স ইত্যাদি। এর মধ্য দিয়ে দলটির সমর্থকদের কথা বলার স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই সক্রিয় এই আওয়ামী লীগের ব্যাপক সমর্থক আছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদনে আরও লিখেছে, কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণার পরই নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধনও স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা একটি অধ্যাদেশের ভিত্তিতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিচার চালানো ও তাদের বাতিল করার ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নতুন বিধানে 'সংগঠন' শব্দটির ব্যাখ্যা খুব বিস্তৃতভাবে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে—এটি হতে পারে কোনো রাজনৈতিক দল, সংশ্লিষ্ট কোনো গ্রুপ, অথবা এমন কোনো ব্যক্তি, যিনি ওই সংগঠনের কার্যকলাপ প্রচার বা সমর্থন করেন বলে মনে করা হয়। এই ক্ষমতাগুলো এত বিস্তৃতভাবে খসড়া করা হয়েছে যে, সেগুলো যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া এবং সংগঠনের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মান লঙ্ঘন করতে পারে। এছাড়া, ট্রাইব্যুনালের মতে যারা এই ধরনের (নিষিদ্ধ) দল বা সত্তার প্রচার, সমর্থন, অনুমোদন, সহায়তা বা কার্যকলাপে জড়িত, ট্রাইব্যুনাল তাদেরও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশে হত্যা মামলায় অনেক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন অভিনেতা-অভিনেত্রী, আইনজীবী, সংগীতশিল্পী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী। প্রসিকিউটররা তাদেরকে 'ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনের' সমর্থক বলে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তারের পক্ষে মত দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেসব গুরুতর অনিয়ম হয়েছিল, সেগুলোর সমাধানে দেরি হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। শেখ হাসিনার শাসনের সময় জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা ১৬৭৬টি অভিযোগ পেয়েছে এবং ২০০ জন ভিকটিমের অবস্থান এখনও অজানা। প্রতিবেদনে জোরপূর্বক গুমকে একটি 'সিস্টেমিক ডিজাইন' বা পরিকল্পিত পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার প্রধান ভুক্তভোগী রাজনৈতিক বিরোধীরা। সেখানে ভয়াবহ নির্যাতন ও গোপন বন্দিশিবিরে আটকের অমানবিক পরিস্থিতির কথাও উঠে এসেছে।

এসব বন্দিশিবির পরিচালনা করত বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। তদন্ত কমিশন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় পেয়েছে। কিন্তু গুম সংক্রান্ত প্রস্তাবিত আইনে এই কমিশনের অনুসন্ধানের কোনো ভূমিকা রাখা হয়নি। ব্যাপক ও ধারাবাহিকভাবে যেসব গুম হয়েছে, সেগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে এবং সীমিত সম্পদের ও বিতর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে একটি 'প্রিভেনশন অ্যান্ড রেমেডি অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস' নামে নতুন জাতীয় কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। যারা গুমের জন্য সন্দেহভাজন, তাদের বিচার হবে নতুন একটি ট্রাইব্যুনালে। তবে যেসব গুম 'ব্যাপক বা পদ্ধতিগত' হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো সংস্থারই বিচার করার এখতিয়ার থাকবে না। এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে আগের সরকারের সময়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, জোরপূর্বক গুমের সমস্যায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভুক্তভোগীদের পরিবারে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গুম হওয়া এক ব্যক্তির মা বলেন, 'আমি এখনও আশা করি আমার ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু যদি না আসে, তাহলে যারা এটা করেছে, তাদের বিচার চাই—যাতে কেউ আর কোনো মায়ের সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার সাহস না করে।'

অন্যদিকে, কিছু পরিবারে এখনো ভয় কাজ করছে। যেমন, ভুক্তভোগী পরিবারের সংগঠন 'মায়ের ডাক'-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলামের বাড়ি গত ৮ মে পুলিশ ঘেরাও করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে একটি শক্ত ভিত্তি গড়তে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা। পাশাপাশি, প্রমাণের ভিত্তিতে সাবেক সরকারের যেসব সদস্য অপরাধে জড়িত, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার শুরুর আগেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাউকে বন্দি রাখা উচিত নয়।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি—বিশেষ করে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক গুমের ঘটনায়। যেসব ব্যক্তিরা এসব গুমের পরিকল্পনায় যুক্ত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হলে তদন্ত কমিশনের সংগ্রহ করা তথ্যপ্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা উচিত।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, 'হাসিনার শাসনের সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে, এতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েছে। কিন্তু বিরোধীদের অধিকার হরণ করাটা সঠিক পথ নয়। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নিখোঁজ ব্যক্তিদের ভাগ্য জানা ও অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।'